বর্তমান প্রেক্ষাপটে জেলার সাংবাদিকতা বাংলাদেশের গণমাধ্যম জগতের একটি প্রাণবন্ত এবং অপরিহার্য অঙ্গ। তৃণমূলের সমস্যা ও সম্ভাবনাগুলোকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে আসেন জেলার সাংবাদিকরা। কিন্তু স্থানীয় পর্যায়ের নানা ঘটনা, সমস্যা, সংস্কৃতি ও উন্নয়নকে সংবাদ আকারে উপস্থাপন করা এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ ডিজিটাল প্রযুক্তি যেমন সাংবাদিকতার গতি ও ব্যাপ্তি বাড়িয়েছে; তেমনি আর্থিক নিরাপত্তাহীনতা, পেশাগত ঝুঁকি এবং প্রশিক্ষণের অভাবে চ্যালেঞ্জগুলো দিনে দিনে আরো প্রকট হচ্ছে তাদের জন্য।
একটা সময় হাতেগোনা কিছু পত্রিকাই ছিল জেলার সাংবাদিকদের তথ্য তুলে ধরার একমাত্র মাধ্যম। আর এখন এর ব্যাপ্তি বহুমুখী, সংবাদপত্র ছাড়াও গণমাধ্যমের বহরে যুক্ত হয়েছে অসংখ্য টেলিভিশন, কমিউনিটি রেডিও, ওয়েবসাইট ভিত্তিক অনলাইন পত্রিকা। সবশেষ সংবাদের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হয়ে উঠছে ফেসবুক, ইউটিউব, এক্সসহ নানা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। প্রযুক্তির এই দৌড়ে জনসম্পৃক্ততা যেমন বাড়ছে, তেমনি এখন সাংবাদিকতার জায়গাটাও ধীরে ধীরে আরো জটিল হয়ে উঠছে। যার কাছে যা তথ্য আছে তা জেনে না জেনে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। এতে জেলার সাংবাদিকতায় তৈরি হচ্ছে অগ্রহণযোগ্যত ও বাড়তি চাপ। কারণ এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করাটাও বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে সাংবাদিকদের কাছে। প্রচারের মাধ্যম দিনে দিনে যতো বাড়ছে, সাংবাদিকতার ক্ষেত্র যেনো ততো ছোট হয়ে আসছে।
অন্যান্য দিক বিবেচনায় জেলার সাংবাদিকতা প্রতিনিয়তই একটি চাপের মধ্যেই থাকছে।সঠিক তথ্য বের করা, আইনগত প্রেক্ষাপট, নিরাপত্তা ঝুঁকি- বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে বড় বাধা, এছাড়া হয়রানির মতো নানা ঘটনা তো রয়েছেই। যা নিরপেক্ষ সাংবাদিকতাকে প্রভাবিত করে চলেছে। আরো উল্লেখযোগ্য হলো:
• প্রবেশাধিকার: একজন সাংবাদিকের জন্য প্রায় সব জায়গাতে অবাধ চলাচল থাকা জরুরি। কিন্তু জেলা পর্যায়ে দেখা যায়- সরকারি-স্বায়ত্বশাসিত, বেসরকারি অফিস/ভবনে প্রবেশাধিকার নিষেধ করা হয়। সাংবাদিকদের চলাফেরা সংকুচিত হওয়ায় জেলাকে সংবাতের সঠিক তথ্য পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।
• ফ্যাক্ট চেকিং ও ভুলতথ্য: ২০২৪ সালে প্রচারিত/প্রকাশিত সংবাদের মধ্যে ৫৮% রিপোর্টেই ভুল বা অসত্য তথ্য চিহ্নিত হয়েছে। রাজনীতি, স্বাস্থ্য, দুর্নীতিসহ নানা ক্যাটাগরিতে ছিল এসব ভুল।এসব সংবাদের প্রায় সবগুলোই আসে জেলা থেকে। জেলার সাংবাদিকদের তথ্যযাচাইয়ের চর্চা একেবারেই কম থাকায় দিনে দিনে তা আরো বেড়ে চলেছে। তবে একই সময়ে কিছু গণমাধ্যমে ভুয়া খবর প্রচারের হার কমার দৃষ্টান্তও উঠে আসে।
• রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস -এর তথ্য মতে, বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান অনেক নিচে। এই সূচকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জেলায় বা স্থানীয় সাংবাদিকরা প্রায়শই হামলা/আক্রমণের শিকার হন এবং তাদের বিরুদ্ধে মামলাকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার উদ্বেগজনক। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার রিপোর্টেও এসেছে একই তথ্য।
তবে এসব চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি জেলায় সাংবাদিকতার ইতিবাচক নানা দিক এবং সম্ভাবনাও রয়েছে।যেমন- ডিজিটাল মাধ্যমের প্রসার হওয়ায়, এখন জেলার অনেক সাংবাদিক নিজেদের উদ্যোগে অনলাইন পোর্টাল, ব্লগ বা ইউটিউব চ্যানেল খুলছেন। এসব মাধ্যমে তারা স্বাধীনভাবে নিজেদের মতামত ও তথ্য তুলে ধরার সুযোগ পাচ্ছেন। শিক্ষিত তরুণরাও প্রত্যন্ত এলাকায় ব্লগিং এর মাধ্যমে সাংবাদিকতায় জড়িয়ে পড়ছেন। এসব তরুণদের মাধ্যমে উঠে আসছে নতুন নতুন ঘটনা, গল্প এবং স্টোরি টেলিং এর নতুন টেকনিক। তাদের কণ্ঠস্বরই কখনো কখনো জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে অবলীলায়। এতে স্থানীয় সাফল্যের গল্প, সংস্কৃতির রূপ, অবিচারের কাহিনী হয়ে উঠছে ইতিবাচক ইমেজের একটি করে স্তম্ভ। স্থানীয় সাংবাদিকরা সরাসরি জনগণের কাছাকাছি থাকায়, এমন কিছু খবর সংগ্রহ করতে পারেন, যা জাতীয় পর্যায়ের সংবাদমাধ্যমে তুলে ধরা সম্ভব না হলেও পৌঁছে যাচ্ছে আম জনতার হাতের মুঠোয়। ডিজিটাল প্লাটফর্মে তাদের ছোট ছোট কাজের মাধ্যমে ইতিবাচক পরিবর্তন আসছে সমাজে।
তবে এসব খবরে দেখা যায়- মানা হয়না সাংবাদিকতার নূন্যতম কোন এথিক। এতে কোন কোন ঘটনায় উঠে আসছে অপসাংবাদিকতা, যা গণমানুষকে বিভ্রান্তিতে ঠেলে দিচ্ছে; যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সমাজ, মানুষ ও দেশের ওপর।
জেলার সাংবাদিকরা জাতীয় গণমাধ্যমের ‘চোখ ও কান’ হিসেবে কাজ করেন তা অস্বীকার করার উপায় নেই। প্রকৃত অর্থে তাদের এই সাংবাদিকতাকে আরো গ্রহণযোগ্য, বস্তুনিষ্ঠ এবং পেশাদার হিসাবে গড়ে তোলার জন্য সবার আগে প্রয়োজন-
. নিরাপত্তা নিশ্চিত করা
. আর্থিক স্বস্তি দেয়া
. সাংবাদিকতার প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ এবং
. পেশাগত উন্নয়নে মানসম্মত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা
এসব সম্ভব হলেই দেশের গণতন্ত্র ও স্বচ্ছ সুশাসন আরো শক্তিশালী হবে। এজন্য কেবল মিডিয়া হাউসগুলোই নয়- সরকার, সুশীল সমাজ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে দায়িত্ব নিয়ে গড়ে তুলতে হবে পেশাদার সাংবাদিক।
চলবে…
লেখক
নজরুল ইসলাম তমাল
কান্ট্রি এডিটর, ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন