চলমান ২০২৫ সনের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর মাসে সেটেলার বাঙালি, বহিরাগত বাঙালি শ্রমিক ও ব্যক্তি কর্তৃক জুম্ম নারী ও শিশু ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা, ধর্ষণের চেষ্টা, উত্যক্তকরণ ইত্যাদি ২১টি সহিংস ঘটনা সংঘটিত হয়েছে এবং এতে এই পর্যন্ত ২৯ জন জুম্ম নারী ও শিশু মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছেন।
পার্বত্য চট্টগ্রামে নারী সহিংসতার ঘটনা নতুন কিছু নয়। দশকের পর দশক ধরে চলা এইসব সহিংসতার ঘটনার শিকার নারী ও শিশুর সংখ্যা অগণিত হলেও পাহাড়ের মানুষ এই সব ঘটনার সুষ্ঠু বিচার আজও পেয়েছেন এমন দৃষ্টান্ত নেই বললেই চলে। পার্বত্য চট্টগ্রামে এই যাবত কালে সংঘটিত নারী সহিংসতার ঘটনা বিশেষত ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা, অপহরণের মতন বর্বর পৈশাচিক ঘটনাবলীর বিচার তো দূরে থাক সঠিক তদন্ত পর্যন্ত করা হয়নি।
এরই ধারাবাহিকতায় খাগড়াছড়ি সদরের সিঙ্গিনালা এলাকায় এক জুম্ম কিশোরীকে সেটেলার বাঙালি কর্তৃক গণধর্ষণের ঘটনায় গত ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ‘জুম্ম ছাত্র-জনতা’র সাথে সেটেলার বাঙালিদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ফলে অন্তত ৩ তিন জুম্ম গুরুতর আহত এবং ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ খাগড়াছড়ি জেলার গুইমারা রামসু বাজার ও এর আশেপাশের জুম্ম বসতিতে সেনাবাহিনী, বাঙালি সেটেলার ও বহিরাগত দুষ্কৃতিকারীদের কর্তৃক সম্মিলিভাবে উপর্যুপরি হামলায় ৩ জন জুম্ম নিহত এবং অন্তত ২০ জনের অধিক আহত হয়েছে। এছাড়া রামসু বাজারে জুম্মদের ৫৪টি দোকান, ২৬টি ঘরবাড়ি ও ১৬টি মোটরসাইকেল অগ্নিসংযোগে ভস্মীভূত হয়। এতে জুম্মদের প্রায় ২৫ কোটি টাকার সম্পত্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানা যায়।
ঘটনার সূত্রপাত:
খাগড়াছড়ি জেলার খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার পৌরসভা এলাকায় তিন জন সেটেলার বাঙালি যুবক কর্তৃক হাই স্কুলে পড়–য়া এক মারমা শিক্ষার্থী (১২) গণধর্ষণের শিকার হয়। ঘটনাটি গত ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ রাত ৯টা হতে রাত ১১টার মধ্যে খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার পৌরসভার সিঙ্গিনালা ১নং ওয়ার্ডের শাসন রক্ষিত বৌদ্ধ বিহারের পূর্ব পাশে সংঘটিত হয়। ভুক্তভোগী ঐ মেয়েটি খাগড়াছড়ি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণির ছাত্রী, তার বাড়ি সিঙ্গিনালা ১নং ওয়ার্ড এলাকায়।
এই ঘটনার জেরে ভুক্তভোগীর পিতা মংসাজাইং মারমা (৪৮) নিজে বাদী হয়ে এবিষয়ে খাগড়াছড়ি সদর থানায় মামলা দায়ের করেন। এই সময় মামলা করার সময় মামলায় মংসাজাইং মারমা ‘ধর্ষণকারীরা সেটেলার বাঙালি যুবক’ বলে উল্লেখ করতে চাইলেও কর্তব্যরত পুলিশ কর্মকর্তার পরামর্শে তাকে ‘অজ্ঞাতনামা ৩ জন’ বলে উল্লেখ করতে হয়।
উল্লেখিত মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, ভুক্তভোগী ছাত্রী প্রতিদিন সন্ধ্যা ৬টার দিকে নিজ বাড়ি থেকে একই এলাকার শিক্ষক উশাচিং মারমার বাড়িতে প্রাইভেট পড়তে যায় এবং রাত ৯টার দিকে বাড়িতে ফিরে আসে। সেদিনও (২৩ সেপ্টেম্বর) সে শিক্ষক উশাচিং মারমার কাছে প্রাইভেট পড়তে যায়। কিন্তু রাত ৯:৩০ টার পরও ছাত্রীটি বাড়িতে ফিরে না আসায় উদ্বিগ্ন ছাত্রীর পিতা শিক্ষক উশাচিং মারমার বাড়িতে খোঁজ করতে যায়। ছাত্রীর পিতা মংসাজাইং মারমা জানতে পারেন যে, তার মেয়ে যথারীতি রাত ৯টার সময়ই বাড়ির উদ্দেশে চলে গেছে। এতক্ষণে বাড়িতে পৌঁছার কথা থাকলে সে বাড়িতে ফেরেনি।
তখন উদ্বিগ্ন মংসাজাইং মারমা আত্মীয়স্বজন ও গ্রামবাসীদের সহায়তায় তার মেয়েকে খুঁজতে শুরু করেন। খোঁজাখুঁজির এক পর্যায়ে রাত আনুমানিক ১১টার দিকে পৌরসভার সিঙ্গিনালা ১নং ওয়ার্ডে অবস্থিত শাসন রক্ষিত বৌদ্ধ বিহারের পূর্ব পার্শ্বে মাটি ভরাতকৃত জায়গার উপর অজ্ঞান অবস্থায় মেয়েটিকে খুঁজে পাওয়া যায়। এরপর পানি এনে অচেতন মেয়েটির মাথায় ও মুখে পানি ছিটিয়ে দিলে মেয়েটির জ্ঞান ফিরে আসে।
এরপর মেয়ে ও তার পিতার বয়ান থেকে জানা যায়, রাত ৯টার দিকে বাড়ি ফেরার পথে সবিতা চাকমার দোকানের কাছাকাছি পৌঁছলে পেছন থেকে ৩ সেটেলার বাঙালি যুবক মুখ চেপে ধরে মেয়েটিকে জোরপূর্বক শাসন রক্ষিত বৌদ্ধ বিহারের পূর্ব পার্শ্বে মাটি ভরাতকৃত জায়গায় নিয়ে যায়। এরপর মেয়ের নাকে-মুখে চেতনানাশক ঔষধ ছিটিয়ে দিয়ে অজ্ঞান করে সেটেলার বাঙালিরা পালাক্রমে মেয়েটিকে ধর্ষণ করে।
গণধর্ষণের প্রতিবাদে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ
উক্ত ধর্ষণের প্রতিবাদে ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫ রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে জুম্ম শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে এবং ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫ বান্দরবান, চট্টগ্রাম মহানগর ও ঢাকায় প্রতিবাদ সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল আয়োজন করা হয়।
সেনাবাহিনী কর্তৃক এক প্রতিবাদী জুম্ম যুবককে জোর পূর্বক তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ
গত ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫ রাত আনুমানিক ৮:৩০ ঘটিকার সময়ে উক্যনু মারমা নামে ধর্ষণ ঘটনার প্রতিবাদকারী এক জুম্ম যুবককে খাগড়াছড়ি সদরস্থ মধুপুর বাজারের একটি মুন্ডির দোকান থেকে সেনাবাহিনীর একটি দল বন্ধুবান্ধবের সামনে থেকে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে যায়। খাগড়াছড়ি সদরস্থ ২০৩ পদাতিক ব্রিগেড থেকে দুটি গাড়িতে এসে সেনাবাহিনী কর্তৃক উক্যনু মারমাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়।
সূত্র মোতাবেক, মধুপুর বাজারের পাশে একটি দোকানে বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে উক্যনু মারমা মুন্ডি খাচ্ছিলেন। পরে হঠাৎ সেনাবাহিনীর দুটি গাড়ি এসে উক্যনু মারমাকে কোনো কারণ ছাড়া জোরপূর্বক টেনেহিঁচড়ে তুলে নিয়ে যায়। এই সময় তার পরনে থাকা শার্ট, প্যান্ট ছিঁড়ে যায়।
জানা যায়, উক্যনু মারমাকে সেনাবাহিনীর গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়ার সময় ব্যাপক মারধর করা হয়। পরে তাকে সেনাবাহিনীর ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে জোন কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল খাদেমুল ইসলাম ও দুই জন উচ্চ পদস্থ সেনা কর্মকর্তার উপস্থিতিতে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
এই সময় উক্ত ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে ছাত্র সমাজের পক্ষ থেকে উক্যনু মারমাকে ছেড়ে না দিলে আল্টিমেটাম দিয়ে জোরালো কর্মসূচি ঘোষণা করা হলে এবং ব্যাপক জনরোষে সেনাবাহিনী তাকে রাত আনুমানিক ১০ ঘটিকার সময়ে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। উক্যনু মারমা বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্টস কাউন্সিলের (বিএমএসসি) খাগড়াছড়ি জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক বলে জানা যায়।
উল্লেখ্য, খাগড়াছড়ি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণির ছাত্রীকে তিন সেটেলার বাঙালি কর্তৃক গণধর্ষণের জেরে তিন পার্বত্য জেলা সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালিত হয়। উক্যনু মারমা উক্ত ঘটনায় খাগড়াছড়িতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন বলে জানা যায়। অনেকের ধারণা, উক্যনু মারমা ধর্ষণের প্রতিবাদ করায় সেনাবাহিনী তাকে তুলে নিয়ে যায়।
খাগড়াছড়িতে অবরোধের ডাক
গত ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫ উক্ত গণধর্ষণের প্রতিবাদ ও পাহাড়ে সকল নারী নিপীড়নের বিরুদ্ধে খাগড়াছড়ি সদরস্থ ‘জুম্ম ছাত্র-জনতা’র ব্যানারে এক সমাবেশ আয়োজন করা হয়। সমাবেশে ৪৮ ঘন্টার মধ্যে ধর্ষণকারীদের গ্রেপ্তারের দাবি জানানো হয় এবং ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ভোর ৫ টা হতে ৬ টা পর্যন্ত সমগ্র খাগড়াছড়ি জেলায় সড়ক অবরোধ ঘোষণা করা হয়।
খাগড়াছড়ি অবরোধে ১৪৪ ধারা জারি, সেটেলার বাঙালি কর্তৃক জুম্মদের উপর আক্রমণ
গত ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫ খাগড়াছড়ি জেলায় সকাল-সন্ধ্যা সড়ক অবরোধ কর্মসূচি পালন করা হয়। এই অবরোধে সকালের দিকে বড় ধরনের কোনো সংঘাত বা হামলার কথা জানা যায়নি।
তবে সকাল ১০টার দিকে খাগড়াছড়ি সদরের নারানখাইয়্যা এলাকায় অবরোধকারী জুম্ম ছাত্র-জনতার সাথে সেটেলার বাঙালিদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়, যা প্রায় বিকাল ৩টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। তবে সেই সময় কেউ আহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি।
এই ঘটনায়, খাগড়াছড়ি জেলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এ বি এম ইফতেখারুল ইসলাম খন্দকার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি এবং জনগণের জান ও মালের ক্ষতিসাধনের আশঙ্কা প্রকাশ করে দুপুর ২টা হতে পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত খাগড়াছড়ি পৌরসভা ও সদর উপজেলায় ১৪৪ ধারা জারির আদেশ দেন এবং বিকাল ৩টায় জেলার গুইমারা উপজেলায়ও ১৪৪ ধারা জারির আদেশ দেওয়া হয়।
কিন্তু পরবর্তীতে উক্ত আদেশ জারির কয়েক ঘন্টা পরেই সেটেলার বাঙালিদের কর্তৃক সংঘবদ্ধভাবে জুম্মদের বিভিন্ন এলাকায় হামলা শুরু হয়। এতে অন্তত ৩ জন গুরুতর আহত হয়।উক্ত আহত ব্যক্তিরা হলেন-(১) রিকন চাকমা ওরফে বারিজে (২৯), পীং-ভাক্তা চাকমা, ঠিকানা-রাণীপাড়া, বড়াদম, দীঘিনালা উপজেলা; (২) কুমিয়া ত্রিপুরা (২৫), ঠিকানা-আমতলী, কমলছড়ি, খাগড়াছড়ি সদর উপজেলা এবং (৩) কংসাই মারমা ওরফে মংসাঅং (২২), ঠিকানা-আমতলী, কমলছড়ি, খাগড়াছড়ি সদর উপজেলা।
সেটেলার বাঙালি দ্বারা জুম্মদের উপর হামলায় আহতদের মধ্যে অধিকতর গুরুতর আহত অবস্থায় রিকন চাকমাকে খাগড়াছড়ি পার্কসাইড হাসপাতাল থেকে চট্টগ্রামে স্থানান্তর করা হয়। রিকন চাকমা পেশায় একজন পিক-আপ ড্রাইভার। খাগড়াছড়ি হাসপাতালে তার মাথায় ১৭টি সেলাই হয়েছে বলে জানা যায়। তিনি নারানখাইয়্যা এলাকায় সেটেলার বাঙালিদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে আহত হন।
জানা যায়, দুপুর ২টায় ১৪৪ ধারা জারির পর, বিকাল ৪টার দিকে সেটেলার বাঙালিদের একটি দল খাগড়াছড়ি সদরের মহাজন পাড়ায় ধারালো অস্ত্র এবং কান্তা ও ধাতব গুলি নিয়ে হামলা চালায়। এসময় সেটেলার বাঙালি ও মহাজন পাড়ার ছাত্র-জনতার মধ্যে কয়েক ঘন্টা যাবৎ ধাওয়া ও পাল্টা ধাওয়া চলে। এসময় সেটেলার বাঙালিরা নিজেরা একটি অ্যাম্বুলেন্সে হামলা ও ভাঙচুর চালিয়ে, পরে তারা জুম্মরা হামলা ও ভাঙচুর চালায় বলে সামাজিক মাধ্যমে প্রচার চালায়।
এছাড়া বিদেশি অর্থায়নে নির্মাণাধীন উপজেলা মডেল মসজিদের গম্বুজ ও ছাদ থেকে একদল সেটেলার বাঙালি জুম্মদের উপর ইটপাটকেল ও গুলতি ছোঁড়ে। এসময় তারা গুলতির গুলি হিসেবে সীসা ও পরিত্যক্ত বন্দুকের গুলিও ব্যবহার করে। শুধু তাই নয়, সেটেলাররা নিজেরাই মসজিদের কিছু গ্লাস ভেঙে পরে জুম্মরা ভেঙে দিয়েছে বলেও অপপ্রচার চালায় বলে জানা যায়।
এই ১৪৪ ধারা জারির মধ্যেও রাত ৭টার দিকে সেটেলার বাঙালিদের আরো দুটি দল সংঘবদ্ধ হয়ে পরপর জুম্ম অধ্যুষিত গঞ্জপাড়া গ্রাম এবং খাগড়াছড়ি বাজার এলাকার য়ংড বৌদ্ধ বিহার সংলগ্ন এলাকায় জুম্মদের উপর হামলা চালায়।
এসময় সেটেলার বাঙালিদের ধারালো অস্ত্র ও লাঠিসোটার আঘাতে য়ংড বৌদ্ধ বিহার এলাকায় কুমিয়া ত্রিপুরা ও কংসাই মারমা ওরফে মংসাঅং মারমা গুরুতর আহত হন। পরে গুরুতর আহত অবস্থায় তাদের খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়।
একই দিন রাত ৮টার দিকে জানা যায়, সেটেলার বাঙালিদের আরেকটি দল খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামের নিকটবর্তী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)-এর সদরদপ্তরের পাশে অবস্থান নেয়। এছাড়া স্টেডিয়ামের পাশে সেনাবাহিনী একটি নতুন চেকপোস্ট বসায় এবং কিছু বাংকার খনন করে।
গুইমারায় অবরোধ কর্মসূচির দ্বিতীয় দিনে জুম্মদের উপর ভয়াবহ হামলা ও অগ্নিসংযোগ
গত ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ মারমা স্কুল ছাত্রী ধর্ষণের প্রতিবাদে এবং সকল ধর্ষণকারীকে গ্রেপ্তারের দাবিতে ‘জুম্ম ছাত্র-জনতা’র ব্যানারে খাগড়াছড়ি জেলায় সকাল-সন্ধ্যা সড়ক অবরোধ কর্মসূচির দ্বিতীয় দিন পালন করা হয়। এইদিন সকাল থেকে বিকাল প্রায় ৪টা পর্যন্ত জেলার গুইমারা উপজেলায় অবরোধকারী জুম্মদের উপর এবং বাড়ি ও বসতিতে ভয়াবহ হামলা চালানো হয়। এছাড়া খাগড়াছড়ি সদর এলাকার চারটি স্থানে সেনাবাহিনী লাঠিচার্জ চালায়।
ঐ দিন সকাল বেলায় গুইমারার রামসু বাজার সংলগ্ন উপজেলার খাদ্যগুদামের সামনে সড়কের উপর অবরোধকারী একদল জুম্ম ছাত্র-জনতা দাঁড়িয়ে কর্মসূচি পালন করার চেষ্টা করছিল।
এক পর্যায়ে সেখানে সেনাবাহিনীর একটি দল, সেটেলার বাঙালিদের একটি দল, এছাড়া সেনাবাহিনীর সাথে মুখোশ পরিহিত অস্ত্রধারী বহিরাগত কিছু লোকও সেখানে উপস্থিত হয়। এসময় প্রথমে সেনাবাহিনী অবরোধকারী ছাত্র-জনতাকে সড়ক থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেয়। এতে সেনাবাহিনীর সদস্যদের সাথে অবরোধকারী ছাত্র-জনতার মধ্যে বাকবিতন্ডা হয়। এরপর সেনাবাহিনী জোরপূর্বক ছাত্র-জনতার জমায়েত ভেঙে দেয়।
এসময় দুপুর প্রায় ১২টার দিকে সেনাবাহিনী ও বাঙালি সেটেলারদের সাথে অবরোধকারী ছাত্র-জনতার মধ্যে ধাওয়া ও পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়। এর মধ্যেই সেটেলার বাঙালিরা রামেসু বাজারে দোকানপাটে এবং আশেপাশের জুম্মদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ শুরু করে, মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেয়, দোকানে লুটপাট চালায়। এতে উভয়পক্ষে মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলে।
অপরদিকে, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার এক পর্যায়ে ছাত্র জনতার একটি অংশ পেছন থেকে সেনাবাহিনীকে লক্ষ্য করে ইট পাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে। উভয় পক্ষের এই ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার সময়েই দুপুর প্রায় ১টার দিকে সেনাবাহিনী ও মুখোশপড়া দুস্কৃতিকারীরা একসঙ্গে অবরোধ পালনকারী জুম্ম ছাত্র-জনতার উপর একের পর এক গুলি চালায় বলে একাধিক প্রত্যক্ষদর্শীর সূত্রে জানা যায়। সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগীদের গুলিতে আখ্র মারমা (২২), থোয়াইচিং মারমা (২০) ও আথুইপ্রু মারমা (২১) নামে তিনজন নিহত ব্যক্তি হয়। অবরোধকারীদের নিক্ষিপ্ত ইট পাটকেলের আঘাতে ১১ জন সেনা সদস্য আহত হয়। সেনাবাহিনী, বাঙালি সেটেলার ও মুখোশপড়া দুস্কৃতিকারীদের কর্তৃক এই হামলা বিকাল ৪টা পর্যন্ত স্থায়ী হয় বলে জানা যায়।
অপরদিকে বাজারে পুড়ে যাওয়া এক দোকানের মালিক, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রত্যক্ষদর্শীর মতে, গুলিতে ও সেটেলারদের হামলায় অন্তত ৩ জন জুম্ম নিহত হয়। তার মতে, কয়েকজনকে খুন করে দোকানের আগুনে ছুঁড়ে ভস্মীভূত করা হয়েছে। এছাড়া, অন্তত ৫ জন জুম্ম নিখোঁজ রয়েছে। তাদের মধ্যে তিন জনের নাম হল- থোয়াইচিং মারমা, চিংপ্রু মারমা ও আথুইপ্রু মারমা।
সেনাবাহিনী ও দুস্কৃতিকারীর গুলিতে ও সেটেলার বাঙালিদের হামলায় অন্তত ২০ জন জুম্ম নারী-পুরুষ গুরুতর আহত হয়েছে। তাদের মধ্যে অন্তত ১১ জন খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে ভর্তি হয় এবং ১ জনকে গুরুতর অবস্থায় চট্টগ্রামে স্থানান্তর করা হয় বলে জানা যায়। ২০ জন আহতদের মধ্যে ১৬ জনের নাম পাওয়া গেছে।
এছাড়া রামসু বাজারে জুম্মদের ৫৪টি দোকান, ২৬টি ঘরবাড়ি ও ১৬টি মোটরসাইকেল অগ্নিসংযোগে ভস্মীভূত হয়। এতে জুম্মদের প্রায় ২৫ কোটি টাকার সম্পত্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানা যায়।
খাগড়াছড়ি সদরে সেনাবাহিনীর লাঠিচার্জ: এক বৃদ্ধা আহত
একইদিন (২৮ সেপ্টেম্বর) খাগড়াছড়ি ব্রিগেডের সেনাবাহিনীর সদস্যরা খাগড়াছড়ি সদরের অন্তত চারটি স্থানে জুম্মদের উপর অতর্কিতে বেধরক লাঠিচার্জ চালায়। সেনাবাহিনীর সদস্যরা প্রথমে সকাল ৮টার দিকে স্বনির্ভর বাজার এলাকায় জুম্মদের উপর লাঠিচার্জ করে। এরপর গিরিফুল, মনিগ্রাম ও কুরদিয়াছড়া এলাকায় হঠাৎ উপস্থিত হয়ে সেনা সদস্যরা জুম্ম গ্রামবাসী যাকে পেয়েছে তাকে মারধর করেছে। এসময় বিশেষ করে কুরদিয়াছড়া এলাকায় ৭০ বছরের এক বয়স্ক জুম্ম নারী আবাইমা মারমা (৭০), গ্রাম-উগলছড়ি, পানছড়ি-কে লাঠিচার্জ করে রক্তাক্ত করে।
গত ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ সকাল ১০:০০ ঘটিকার সময় সেনাবাহিনীর একটি দল ভাইবোনছড়ার জুরমরং বাজারে গিয়ে দোকানপাট বন্ধ করার নির্দেশ দেয়। এ সময়ে ভাইবোনছড়া ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা পানছড়ি কলেজের শিক্ষক জুনান চাকমা (৩৮), পিতা: দর্শন চাকমা-কে শারীরিক নির্যাতন করে। পল্লী চিকিৎসক জ্যোতি শংকর চাকমা (৪২), পিতা- অমিয় চাকমাকে মারধর করা হয়।
খাগড়াছড়ি ও গুইমারা ঘটনায় ইউপিডিএফের উস্কানি
বিভিন্ন সূত্র মোতাবেক, খাগড়াছড়িতে এক জুম্ম নারীকে সেটেলার বাঙালি কর্তৃক সংঘবদ্ধ ধর্ষণের প্রতিবাদে দেশের বিভিন্ন স্থানে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল আয়োজন করা হয়। গত ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫ উক্ত গণধর্ষণের প্রতিবাদ ও পাহাড়ে সকল নারী নিপীড়নের বিরুদ্ধে খাগড়াছড়ি সদরস্থ ‘জুম্ম ছাত্র-জনতা’ ব্যানারে এক মহাসমাবেশ আয়োজন করা হয়। কিন্তু উক্ত সমাবেশে ইউপিডিএফের কতিপয় লোক সমাবেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে শুরু হতে নানাভাবে সমাবেশটিতে বিশৃংঙ্খলা ও বিভিন্ন উস্কানি প্রদান করতে থাকে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। অনুরূপভাবে গুইমারা ঘটনায়ও ইউপিডিএফের উস্কানীতে সহিংস রূপ লাভ করেছিল বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়।
খাগড়াছড়ির এক জুম্ম নারীকে গণধর্ষণের প্রতিবাদে বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্ট কাউন্সিল (বিএমএসসি), খাগড়াছড়ি জেলার সাধারণ সম্পাদক, উক্যনু মারমা প্রারম্ভে আন্দোলনের নেতৃত্ব পরিচালনা করেন ঠিকই কিন্তু পরবর্তীতে ২৭ ও ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ অবরোধ কর্মসূচিগুলোতে বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্ট কাউন্সিল (বিএমএসসি) সাংগঠনিকভাবে সংযুক্ত নয় বলে একটি বিবৃতি প্রদান করে। ফলে এই থেকে বোঝা যায়, সেটেলার বাঙালি কর্তৃক জুম্ম নারীকে গণধর্ষণের প্রতিবাদের আন্দোলনকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করা জন্য প্রসিতপন্থী ইউপিডিএফ কর্তৃক ছাত্রদের যৌক্তিক আন্দোলনকে নানাভাবে উস্কানি দিয়েছিল। এছাড়া দেশে-বিদেশে অবস্থানকারী ইউপিডিএফ-এর সমর্থক, পরামর্শক ও সহযোগী হিসেবে পরিচিত দুয়েকজন ব্লগার ও ব্যক্তি সামাজিক মাধ্যমেও বিভিন্ন বিভেদমূলক, উস্কানিমূলক ও হঠকারী বক্তব্য দিতে দেখা যায়।
উপসংহার
পার্বত্য চট্টগ্রামে চলমান সাম্প্রদায়িক হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা নতুন কিছু নয়। ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের পর বিশেষ মহলের পৃষ্ঠপোষকতায় এই পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে অন্তত ২২টি সাম্প্রদায়িক হামলা সংঘটিত হয়েছে। এ ধরনের সাম্প্রদায়িক হামলার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করা এবং সে লক্ষ্যে জুম্মদের অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা, জুম্মদের ভূমি জবরদখল করা, তাদের চিরায়ত জায়গা-জমি থেকে উচ্ছেদ করা, জুম্ম নারী ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা, সর্বোপরি জুম্মদের মধ্যে ত্রাসের সঞ্চার করা।
বস্তুত পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের লক্ষ্যে স্বাক্ষরিত ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের মধ্যেই পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধানের পথ নিহিত রয়েছে।
সুপারিশমালা:
১। ২৭ ও ২৮ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি ও গুইমারায় সংঘটিত সাম্প্রদায়িক হামলার বিচার বিভাগীয় তদন্তের ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
২। নিহত ও আহত ব্যক্তি এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে সরকারের তরফ থেকে যথোপযুক্ত ক্ষতিপূরণ ও চিকিৎসা প্রদান করা।
৩। খাগড়াছড়ি-গুইমারায় সাম্প্রদায়িক হামলায় জড়িত ব্যক্তিদেরকে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা।
প্রেস বিজ্ঞপ্তি