রাঙামাটিতে স্থাপন করা হচ্ছে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের (বিকেএসপি) একটি আঞ্চলিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থাপনায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বিকেএসপি। বর্তমানে ভূমি অধিগ্রহণের জন্য সম্ভাব্যতা যাচাই চলছে।
এটি নির্মিত হচ্ছে রাঙামাটি সদরের ১০৪ নং ঝগড়াবিল মৌজার তঞ্চঙ্গ্যাপাড়া এলাকার কাপ্তাই হ্রদপরিবেষ্টিত মনোরম স্পটে। এলাকা পরিদর্শন শেষে জমি অধিগ্রহণের জন্য স্পটটি নির্বাচন করা হয় বলে জানা গেছে।
জানা যায়, ৪ আগষ্ট রাঙামাটি সদরসহ জেলার চার এলাকায় জমি পরিদর্শন করে গেছেন বিকেএসপির মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মুনীরুল ইসলাম। ওই সময় রাঙামাটি সদরের ঝগড়াবিল মৌজার আসামবস্তির তঞ্চঙ্গ্যাপাড়া, রাঙাপানির লুম্বিনী এবং কাউখালীর দুটি স্থান সরেজমিন দেখে যান তিনি।
এরপর ১ সেপ্টেম্বর যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. সগীর হোসেনের নেতৃত্বে একটি কমিটি সম্ভাব্যবতা যাচাইয়ে ওইসব এলাকায় জমি পরিদর্শন করেছেন। ওই সময় কমিটির সভাপতি সগীর হোসেনসহ অন্য সদস্য জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের চেয়ারম্যানের একান্ত সচিব মো. সাইফুল ইসলাম ও উপপরিচালক মো. আওলাদ হোসেন উপস্থিত ছিলেন।
পরিদর্শনের পর বর্তমানে রাঙামাটি সদরের ঝগড়াবিল মৌজার স্পটটি অধিগ্রহণের জন্য প্রাথমিক প্রস্তাবনা প্রস্তুত করা হচ্ছে। এজন্য প্রয়োজন ৪০ একর উপযুক্ত জায়গা।
এদিকে বিকেএসপির স্থাপনার জন্য রাঙামাটি সদরের ঝগড়াবিল মৌজার প্রস্তাবিত এলাকায় অন্তত ৯০ একর জায়গা সরকারকে অধিগ্রহণে ছেড়ে দিতে স্বেচ্ছায় আগ্রহ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় সংশ্লিষ্ট জমির মালিকরা।
জেলা প্রশাসক বরাবর দেওয়া এক লিখিত আবেদনে এলাকাটির ৬৮ জমির মালিক স্বেচ্ছায় এ আগ্রহের কথা জানিয়েছেন। তারা এতে বলেন, বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে রাঙামাটি জেলার অবদান বিশাল।
এ জেলার বহু প্রতিভাবান নারী ও পুরুষ ক্রীড়াক্ষেত্রে দেশে বিদেশে সুনাম অর্জন করেছেন, যাতে করে বিশ্বে উজ্জ্বল করতে সক্ষম হয়েছেন দেশের গৌরব ও ভাবমূর্তি।
বিশেষ করে ফুটবলে চিংহ্লামং চৌধুরী মারী, দিল বাহাদুর, অরুণ দেওয়ান, বরুণ দেওয়ান, জয়া চাকমা, কিংশুক চাকমা, ঋতুপর্ণা চাকমা, মনিকা চাকমা, রুপনা চাকমা, বীতশোক চাকমা, আনুচিং মগিনি, বক্সার সুর কৃঞ্চ চাকমা ও ইমন তঞ্চঙ্গ্যা অসামান্য সাফল্য অর্জন করেন। এছাড়াও বাস্তবে রাঙামাটিসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের আনাচে-কানাচে আরও বহু সম্ভাবনাময় প্রতিভা লালিত হচ্ছে। অথচ পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার অভাবে তারা পিছিয়ে।
রাঙামাটি সদরে বিকেএসপির আঞ্চলিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি হলে তিন পার্বত্য জেলাসহ কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম জেলার প্রতিভাবান ক্রীড়াবিদ তৈরি হওয়ার সুযোগ ও অবস্থান গড়ে উঠবে। তাই বৃহত্তর ও সামগ্রিক স্বার্থে আমরা নিজেদের জমি অধিগ্রহণে ছেড়ে দিতে আগ্রহী।
এদিকে রাঙামাটি সদরে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একটি আঞ্চলিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়ায় পাহাড়ি অঞ্চলের ক্রীড়াঙ্গনে ব্যাপক আশা জাগাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট অনেকে বলেন, কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠা হলে স্থানীয় খেলোয়াড়দের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাপক খ্যাতি অর্জনের সুযোগ এবং দেশের জন্য আরও ভালো ক্রীড়াবিদ তৈরি হবে। রাঙামাটিসহ পাহাড়ি অঞ্চল থেকে জাতীয় দলে খেলোয়াড় উঠে আসার ধারাবাহিকতা বজায়সহ নতুন প্রতিভাবানদের সুযোগ করে দিতে কেন্দ্রটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এ অঞ্চলের ক্রীড়া পরিকাঠামোর উন্নয়নে এই কেন্দ্রটি সহায়তা করবে। নারী ফুটবলার ঋতুপর্ণা, রুপনা এবং বক্সিংয়ে সুর কৃঞ্চ চাকমার মতো খেলোয়াড়দের সাফল্য এই কেন্দ্রের প্রয়োজনীয়তার প্রমাণ।
রাঙামাটির সিনিয়র ও অনুসন্ধানী সাংবাদিক হিমেল চাকমা বলেন, রাঙামাটির বিকেএসপি শাখা নির্মাণে রাঙামাটি থেকে সরিয়ে অন্যত্র নিতে একাধিক গ্রুপ কাজ করছে। শেষে কোথায় বিকেএসপি হয় সেটা দেখার বিষয়।
জমি নির্বাচন বিলম্ব হওয়ায় সুযোগ নিতে বেশ তৎপর সুযোগ সন্ধানী পক্ষগুলো।
হিমেল চাকমা বলেন, আমার অনুসন্ধানে পেয়েছি কাউখালি উপজেলার একাধিক গ্রুপ রাঙামাটি সদর থেকে কাউখালিতে নিতে বেশ তৎপর। এ ছাড়াও কাপ্তাই উপজেলায় ওয়াগ্গা ইউনিয়নে নিতে একটি গ্রুপ তৎপর।
মুলত ভুমি অধিগ্রহণের অর্থ পাওয়ার জন্য এ কাজ করছে পক্ষগুলো।
কেউ এক একর বা তারও বেশি জমি দান দিয়ে নিজেদের পছন্দমতো স্থানে প্রস্তাব করে যাচ্ছে এ পক্ষগুলো।
নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে তারা প্রশাসন তথা সরকারকেও ভুল তথ্য সরবরাহের কাজ করছে। পাশাপাশি উচ্ছেদ আতংক ছড়িয়ে মানুষ খেপানোর চেষ্টা করছে।
হিমেল চাকমা আরো বলেন, আমি ঝগড়াবিল মৌজায় প্রস্তাবিত জায়গায় নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে শুধু এক পরিবারকে পেয়েছি যিনি জায়গা দিতে চায় না।
তার জমি আছে মাত্র ৫ শতক। বাকীরা জমি দিতে প্রস্তুত।
এখানে বিকেএসপি নির্মাণ করা হলে রেকর্ড জমির বাইরে ৫ একরের অধিক রেজিস্ট্রার বিহীন জমি পাবে বিকেএসপি। বিকেএসপির জন্য এটি প্লাস পয়েন্ট।
ভৌগলিক রাজনৈতিক অর্থনীতি আধুনিকতার দিক বিবেচনায় ঝগড়াবিল মৌজায় বিকেএসপি করা হলে সরকার যে উদ্দেশ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিকেএসপি করার উদ্যোগ নিয়েছে তাহলে উদ্দেশ্য সফল হবে।
অন্যদিকে শহরের বাইরে করা হলে রাজনৈতিক অস্থিরতা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বিকেএসপি সেটা খেয়াল রাখা দরকার। কেউ যেন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বিকেএসপিকে জিম্মি করে ফায়দা লুটতে না পারে সেজন্য উপযুক্ত জায়গায় বিকেএসপির জন্য জমি নির্বাচন করা দরকার। যদি না হয় তাহলে এটি কাজে আসবে না।
ঝগড়াবিল মৌজার হেডম্যান সুরঞ্জন দেওয়ান বলেন, যেখানে বিকেএসপির কর্মকর্তারা পরিদর্শনে গেছেন সেখানে ৬০ একরের উপরে জমি আছে। এখানে বিকেএসপি করা হলে উচ্ছেদ হবে না। বরং নিজেদের জমি বিকেএসপিকে দিতে অনেক পরিবার আমার সাথে যোগাযোগ করছে যেন তাদের জমিটি বিকেএসপির অধিগ্রহণের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
এদিকে বিকেএসপির জমি পরিদর্শনকালে কমিটির সদস্যরা বলেছেন, মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা দেওয়ায় রাঙামাটিতে বিকেএসপির আঞ্চলিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনার জন্য উপযুক্ত জায়গার সম্ভাব্যবতা যাচাইয়ে সদরসহ জেলায় কয়েকটি স্থান পরিদর্শন করেছেন।
নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তারা মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দেবেন। পরে মন্ত্রণালয় থেকে নির্বাচিত জমি অধিগ্রহণের জন্য জেলা প্রশাসনকে প্রস্তাবনা পাঠানো হবে।
জেলা প্রশাসক মো. হাবিব উল্লাহ মারুফ বলেন, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে রাঙামাটিতে বিকেএসপির আঞ্চলিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনে উপযুক্ত জমির সম্ভাব্যতা যাচাই চলছে। ইতোমধ্যে বিকেএসপির মহা পরিচালকসহ তদন্ত কমিটির সদস্যরা সদরসহ জেলায় বেশ কয়েকটি জায়গা দেখে গেছেন।
তবে উপযুক্ত জমি অধিগ্রহণের জন্য মন্ত্রণালয় থেকে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে চূড়ান্ত প্রস্তাবনা পাঠানো হয়নি। আনুষ্ঠানিক প্রস্তাবনা পাওয়া গেলে জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু করা হবে।
এ বিষয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা বলেছেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে ঋতুপর্ণা, রুপনার মতো বহু প্রতিভাবান খেলোয়াড় আছে কিন্তু পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার অভাবে তাদের অনেকে উঠে আসতে পারছেন না।
তাই তিন পার্বত্য জেলাসহ আশপাশের জেলায় থাকা ক্রীড়া প্রতিভাবানদের সুযোগ-সুবিধা তৈরি করে দিতে আমি রাঙামাটি সদরে বিকেএসপির একটি আঞ্চলিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার জন্য যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়কে উদ্যোগ নিতে সুপারিশ করেছি।