”পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ১৯৯৭”। পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধান করতে ২ ডিসেম্বর তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকারের সাথে সমাঝোতা করে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস)। সে সমঝোতা চুক্তির বয়স আজ ২৮ বছর। চুক্তির ২৮ বছরেও পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন হয়নি এ চুক্তি।
চুক্তির মুল স্পিরিট ছিল ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। চুক্তি মতে রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান জেলা পরিচালিত হবে পার্বত্য চুক্তির আলোকে।
চুক্তির আলোকে গঠিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রনালয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ। সংশোধন হয় তিন পার্বত্য (রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান) জেলা পরিষদ।
চুক্তিতে উল্লেখ আছে, তিন পার্বত্য জেলার স্থায়ী বাসিন্দাদের প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত হবেন তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের একজন করে চেয়ারম্যান এবং ৩৩ জন করে সদস্য।
নির্বাচিত জেলা পরিষদের সদস্যদের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হবেন পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের একজন চেয়ারম্যান এবং ২২ জন সদস্য।
২৫ সদস্যর আঞ্চলিক পরিষদে পদাধিকার বলে সদস্য হবেন তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান।
পার্বত্য জেলা পরিষদগুলোর সকল কার্যক্রম সমন্বয় করে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের সাথে সমন্বয় করবে আঞ্চলিক পরিষদ। পার্বত্য মন্ত্রনালয় জেলা ও আঞ্চলিক পরিষদের পক্ষ হয়ে অন্যান্য মন্ত্রনালয়ের সাথে সমন্বয় করবে।
পার্বত্য চুক্তির আলোকে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের কাছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, মৎস্য, প্রাণী সম্পদ, সমবায়, ক্রীড়া সংস্কৃতি ইত্যাদি ২৮টির অধিক দপ্তর হস্তান্তর করা হয়। যেগুলো আগে জেলা প্রশাসকের নিয়ন্ত্রণে ছিল।
পার্বত্য চুক্তি মতে জেলা পুলিশ এবং ভূমি দপ্তরটি জেলা পরিষদের কাছে হস্তান্তর করার কথা। কিন্তু দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এখনো হস্তান্তর করা হয়নি।
স্থানীয় বাসীন্দাদের ভোটার তালিকা চুড়ান্ত করে পার্বত্য জেলা পরিষদগুলোর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবার কথা থাকলেও চুক্তির ২৮ বছরেও তা হয়নি।
যে সরকার আসে সে সরকারের মনোনীত ব্যক্তিদের দিয়ে চালানো হচ্ছে অন্তর্বতীকালীন জেলা পরিষদ। ফলে এসব সদস্যদের কাছে সাধারণ মানুষের দাবী দাওয়ার চেয়ে দলীয় দাবী দাওয়া গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায়।
রাঙামাটি জেলা পরিষদের সদস্য মো হাবিব আজম বলেন, জেলা পরিষদগুলো শক্তিশালী নয়। শক্তিশালী করতে হলে নির্বাচনটা জরুরী। ৩৪ সদস্য কাঠামোর জেলা পরিষদ চলছে মাত্র ১৫ জন দিয়ে। এটা যথেষ্ট নয়। আমরা নির্বাচিত সদস্য না হওয়ার কারণে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে অনেক কিছু ভাবতে হয়। পাহাড়ের সমস্যা সমাধানে আমাদের ভাবতে হবে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও গবেষক তনয় দেওয়ান বলেন, শিক্ষিত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ক্ষমতার দ্বন্দে পার্বত্য চুক্তির বিভিন্ন সংকট বিরাজমান রয়েছে। প্রকৃত বঞ্চিত অংশকে ক্ষমতায়ন করা হলে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির সুফল পাওয়া যাবে। না হলে এ সংকট যুগ যুগ ধরে চলমান থাকবে।
এদিকে চুক্তি বাস্তবায়ন বিলম্ব হওয়ার কারণের এর অস্থিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলছে অনেকে। পার্বত্য চুক্তির বৈধতার চ্যালেঞ্জ করে ২০০০ সালে মো. বদিউজ্জামান এবং ২০০৭ সালে সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট মো. তাজুল ইসলাম পৃথক রিট আবেদন করেন। এ দুটি রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০১০ সালে ১২ ও ১৩ এপ্রিল হাইকোর্ট পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইনকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করে। পরবর্তীতে হাইকোর্টের এ রায়ের বিরুদ্ধে সরকার ২০১০ সালেই আপিলের জন্য আবেদন করলে আপীল বিভাগ ২০১১ সালের ৩ মার্চ আপিল বিভাগ সরকারের আপিলের অনুমতি গ্রহণ করে। এরপর থেকে এটি আপিল বিভাগে বিচারাধীন আছে।
সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী নিকোলাস চাকমা বলেন, হাইকোর্ট চুক্তিকে বৈধ বলেছে অপরদিকে আঞ্চলিক পরিষদকে সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক বলেছে। এ রায় আমাদের ভাবীয়ে তুলেছে। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সরকার আপীল করেছে। এখন আপীল বিভাগ যেকোন সময় রায় দিতে পারে। এটি চুক্তির পক্ষে বা বিপক্ষে যেতেও পারে। এ অবস্থায় ভবিষ্যতে পার্বত্য চুক্তি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় সেটা দেখার বিষয়।
১৯৯৮ সালে এ পরিষদ ৫ সদস্য বিশিষ্ট থাকলেও ২০১৫ সালে এর পরিধি বাড়িয়ে করা হয় ১৫ সদস্য। যা বর্তমানেও বিদ্যমান রয়েছে। ২০২৪ সালে আওয়ামীলীগ সরকার পতন হলে ইউনুস সরকার ৭ নভেম্বর গঠন করে ১৫ সদস্য করে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ।
এ ইউনূস সরকারের মেয়াদ ১ বছর অতিক্রান্ত হলেও পার্বত্য চুক্তির অবশিষ্ট ধারা কোনটি বাস্তবায়ন হয়নি।
৭৫ পরবর্তী বিভিন্ন সময় সরকার সমতল অঞ্চল থেকে বাঙালী এনে বসতি নির্মাণের কারণে যে ভূমি বিরোধ সৃষ্টি হয় সে বিরোধ নিরসনের জন্য করা হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০০১। পরবর্তী ২০১৬ সালে এটি সংশোধ করা হলেও এ কমিশন নিষ্পত্তি করে পারেনি কোন ভূমি বিরোধ।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় সহ সভাপতি ঊষাতন তালুকদার বলেন, চুক্তি পরবর্তী ২টি দলীয় সরকার এবং দুটি তত্ববধায়ক সরকার দায়ত্ব পালন করলেও কোন সরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিয়ে এগিয়ে আসেনি। এ সরকার এবং আগামী সরকারের কাছে আমাদের দাবী থাকবে যেন তারা পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে এগিয়ে আসে।




