গত বছর ১ ডিসেম্বর উপ সহকারী প্রকৌশলী থেকে সহকারী প্রকৌশলী চলতি দায়িত্বে পদোন্নতি পায় রাঙামাটি জেলা পরিষদের উপ সহকারী প্রকৌশলী আবু জাফর মো. এরশাদুল হক মন্ডল।
প্রজ্ঞাপন শর্তে ছিল এ দায়িত্ব পদোন্নতি দাবী করা যাবে না। সহকারী প্রকৌশলী লিখলে ও চলতি দায়িত্ব শব্দ ব্যবহার করতে হবে।
অথচ এসব শর্ত উপেক্ষা করে পরিষদে বর্তমানে কর্মরত সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলীকে টপকিয়ে এবং পরিষদের নির্বাহী প্রকৌশলী বিরল বড়ুয়াকে অব্যাহতি দিয়ে ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলীর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আবু জাফর মো. এরশাদুল হক মন্ডলকে। এ পদোন্নতি এবং অব্যাহতি কোনটিই আইন সম্মত হয়নি বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ নিয়ে নানান কথা হচ্ছে জেলা পরিষদ পাড়ায়। প্রশ্ন উঠেছে জেলা পরিষদের প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের কর্মদক্ষতা নিয়ে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, এরশাদুল হক ছিলেন বঙ্গবন্ধু ডিপ্লোমা পরিষদের রাঙামাটি জেলা সভাপতি। ছিলেন রাঙামাটি জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ও সাবেক এমপি দীপংকর তালুকদারের আস্থাভাজন। এ আশীর্বাদে ২০০৯ সালে রাঙামাটি সেনা জোন সদর দপ্তরের সামনে ৮ কোটির অধিক টাকা ব্যয়ে নির্মিত বঙ্গবন্ধু ভাস্কর্য কাজ তদারকি করার দায়িত্ব পান এরশাদ। এ কাজের ৮ কোটি টাকার অনিয়ম নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল।
চলতি দায়িত্বের পদোন্নতি পেয়ে আবার জেলা পরিষদে সহকারী প্রকৌশলী (চলতি দায়িত্ব) পদে যোগদানের জন্য আবেদন করেন এরশাদ।

জেলা পরিষদ সূত্র জানায়, পরিষদে সহকারী প্রকৌশলীর পদ আছে ২ টি। এরমধ্য এক পদে জ্যোতির্ময় চাকমা কর্মরত আছেন। ১ টি শূণ্য পদের বিপরীতে ২ জনকে প্রেষণে আবেদন করলে দুজনের আবেদন গৃহণ করা হলে প্রশাসনিক জটিলতা সৃষ্টি হয়।
জেলা পরিষদ আইনমতে উপসহকারী প্রকৌশলী, সহকারী প্রকৌশলী, নির্বাহী প্রকৌশলীর প্রয়োজন হলে এলজিইডি’র কাছে চাহিদা দিতে হয় জেলা পরিষদকে। কিন্তু সে চাহিদা দেয়নি জেলা পরিষদ।
এছাড়াও আইনমতে নির্বাহী প্রকৌশলীর ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব দেয়া হলে দায়িত্ব পায় সহকারী প্রকৌশলী জ্যোতির্ময় চাকমা।
এ বিষয়ে জ্যোতির্ময় চাকমা বলেন, এরশাদকে নির্বাহী প্রকৌশলীর দায়িত্বটি দেয়া হচ্ছে আমাকে কিছু্ই জানানো হয়নি। এরশাদ আমার জুনিয়র। তাকে যে চলতি দায়িত্ব দেয়া হয় এটি পদোন্নতি নয়।
জেলা পরিষদের সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, সহকারী প্রকৌশলী চলতি দায়িত্ব পাবার পর থেকে এরশাদ চেষ্টা করছেন একটি কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে জেলা পরিষদে থাকার। এ কাজে ব্যবহার করেন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে। এরশাদকে পরিষদে বড় পদে বসাতে সহযোগীতা করেছেন মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা এবং জেলা পরিষদের এক সদস্য।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে দিয়ে বিরল বড়ুয়ার বিরুদ্ধে প্রশাসনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গ, দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ২৪ ঘন্টার মধ্য বিরল বড়ুয়াকে অপসারণ না করলে জেলা পরিষদ শাট ডাউনের হুমকি দিয়ে গত ৫ ফেব্রুয়ারী বিকালে রাঙামাটি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের বরাবর আবেদন দেয়া হয়।
আবেদন পত্র পাবার পরদিনই বৈষম্য বিরোধী ছাত্রদের আবেদনের সূত্র ব্যবহার করে কোন তদন্ত এবং কারণ দর্শানো নোটিশ ছাড়া বিরল বড়ুয়াকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে এরশাদকে দায়িত্ব দিয়ে অফিস আদেশে স্বাক্ষর করেন পরিষদের চেয়ারম্যান কাজল তালুকদার।
এ আদেশ বিরল বড়ুয়াকে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা, নিয়মিত অফিস না করা, ঠিকাদারের অভিযোগ, নৈতিকস্কলনসহ নানা অভিযোগের কথা উল্লেখ করা হয়। জেলা পরিষদের অন্যান্য কর্মকর্তারা বলছেন অফিস আদেশে যা লেখা হয়েছে এটি আপত্তিজনক। আদেশের ভাষা এমন হয় না।
তবে পরিষদের কোন ডেস্ক থেকে এ আদেশ ড্রাফট করা হয়েছে তা কেউ নিশ্চিত করতে পারেনি।
পরিষদের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মনতোষ চাকমা বলেন নির্বাহী প্রকৌশলীকে অব্যাহতি দিয়ে যে আদেশে চেয়ারম্যান স্বাক্ষর করেছেন সেটা কোথায় থেকে গেছে তা তিনি জানেন না।
জেলা পরিষদের একটি সূত্র বলছে আইন ভঙ্গ করে নির্বাহী প্রকৌশলীর পদ পেতে এরশাদ ছাত্রদের ব্যবহার করেছে।
তবে অবিযোগ অস্বীকার করেছেন এরশাদ। বঙ্গবন্ধু ডিপ্লোমা পরিষদের রাঙামাটি জেলা সভাপতি এখনো আছেন কিনা জানতে চাইলে এরশাদ বলেন, তিন বছর আগে সভাপতি ছিলাম। এখন এ পদে আমি নেই। আমি আপনাকে খুব ভালোবাসী। যোগাযোগ রাখবেন আপনাকে দেখব।
এ বিষয়ে বিরল বড়ুয়া বলেন, আমাকে দায়িত্ব হতে অব্যাহতির বিষয়ে আমি শুনেছি, এ ব্যাপারে আমার সাথে কোন আলোচনা হয়নি। ২ জন সহকারী প্রকৌশলী ( চ দা) আবেদন গ্রহণ নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হলে আমি স্বপ্রনোদিত হয়ে বদলীর প্রস্তাব দিয়েছিলাম পরিষদে। এটা মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা এবং চেয়ারম্যান অবগত আছেন। এ পরিষদে আমার ৭ বছর হয়ে গেছে। দুজনের যোগদান পত্র গ্রহণ বিষয়ে আমি অবগত ছিলাম না।
পরিষদের এ প্রশাসনিক জটিলতা বিষয়ে জেলা পরিষদের নির্বাহী কর্মকর্তা নূরুদ্দীন মুহাম্মদ শিবলী নোমান ও মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা খোন্দকার মোহাম্মদ রিজাউল করিমের কাছে জানতে চাইলে কেউ এ কথা বলতে রাজি হননি। প্রশাসনিক বিষয়ে কথা বলতে দুই প্রশাসসিক কর্মকর্তা দুই ধরণের কথা বলেন।
এরশাদ কোন বিবেচনাকে কোন বিবেচনায় দায়িত্ব দেয়া হয়েছে জানতে চাইলে নির্বাহী কর্মকর্তা নূরুদ্দীন মুহাম্মদ শিবলী নোমান বলেন এ বিষয়ে তিনি অবগত নন। এ বিষয়টি চেয়ারম্যান জানবেন।
অন্যদিকে মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা খোন্দকার মোহাম্মদ রিজাউল করিম বলেন, পরিষদের আভ্যন্তরীন সিদ্ধান্ত হয়েছে জেলা পরিষদের সকল বিষয়ে গণমাধ্যমের সাথে কথা বলবেন জেলা পরিষদের সদস্য মিনহাজ মুরশীদ। এ বিষয়ে মিনহাজ জানবেন।
এ ব্যাপারে মিনহাজ মুরশীদের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আসলে এটি কিভাবে হল তিনি জানেন না। কিভাবে কি হয়েছে তা জেনে তিনি পরে কথা বলবেন।
জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কাজল তালুকদার বলেন, বিরল বড়ুয়া ঢাকায় যেতে আবেদন করে রেখেছিলেন আমরা এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ে চিঠি পাঠিয়ে দিয়েছি। এরশাদকে আমরা সাময়িক দায়িত্ব দিয়েছি। এ পদে আমরা আমাদের পছন্দমত একজনকে আনতে চাই। সম্প্রতি দুজন সহকারী প্রকৌশলী জেলা পরিষদে যোগ দিতে আবেদন দিয়েছে আমরা দুজনের আবেদন গ্রহণ করেছি। শূণ্যপদ না থাকা একজন অন্যত্র চলে যাবে এ শর্তে আবেদন গ্রহণ করেছি। তবে আমরা এলজিইডির কাছে এখনো কোন চাহিদা দিই নি।
বিরল বড়ুয়ার অপসারণের চেয়ে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দেয়া আবেদনে স্বাক্ষর আছে ২৪ জনের। তবে এ ছাত্রদের নেতৃত্ব দেয়া মো. রাকিব হাসানের স্বাক্ষর নেই।
এ বিষয়ে তিনি বলেন, আসলে এ আবেদন বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। এ আবেদন কারা দিয়েছে আমি আসলে জানি না।
আবেদনে স্বাক্ষর করা প্রথম ব্যক্তি মো ওয়াহিদুজ্জামান রোমান বলেন, রাকিব হাসান শুরু থেকে আন্দোলনে ছিল এখনো আছে সেটা সত্য। আমরা আবেদন দিয়েছি সেটাও ঠিক। বিরল বড়ুয়ার অপসারণ চেয়েছি মুলত আমরা শুনেছি তিনি দীপংকর তালুকদারের লোক। এ কারণে আমরা তার অপসারণ চেয়ে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের কাছে আবেদন দিয়েছি। তবে বিরল বড়ুয়া ফ্যাসিস্ট দোসর কিনা এ নিয়ে আমাদের কাছে কোন প্রমাণ নেই। কিন্তু আবেদনে কোথাও এ কথাগুলো উল্লেখ ছিল না।
তবে আমরা চাইনা যে এ পদে আবার ফ্যাসিট অনুসারী আসুক। এরশাদ যদি ফ্যাসিট সরকার অনুসারী হয়ে থাকেন এবং জেলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলী হয়ে থাকেন তাকে সরানোর জন্য কাল পরশু আবেদন করব। আমরা জানতাম না এরশাদ বঙ্গবন্ধু ডিপ্লোমা পরিষদের রাঙামাটি সভাপতি।
জেলা পরিষদ আইনে ১ম ও ২য় শ্রেণীর জনবল নিয়োগ দেওয়ার ক্ষমতা না থাকায় এ শ্রেণীর কর্মকর্তার ১১টি পদে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রনালয় অধীনস্থ দফতর থেকে চাহিদা মোতাবেক প্রেষণে এনে পরিষদের কার্যক্রম চালানো হয়। এর মধ্যে থেকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রনালয় থেকে একজন নির্বাহী প্রকৌশলী, একজন সহকারী প্রকৌশলী এবং চারজন উপ সহকারী প্রকৌশলী।
রাঙামাটির স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা বলছেন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন নাম দিয়ে রাঙামাটিতে নানান অপকর্ম করছে কিছু অশৃঙ্খল ছেলে। এদের ব্যবহার করছে কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষ। এদের কার্যক্রমে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হচ্ছে বর্তমান সরকারের কর্মকর্তাদের।
গত ৩১ ডিসেম্বর স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের সাথে অশোভন আচরণ করে রাঙামাটির এ স্ব ঘোষিত বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের ছাত্ররা। সেদিন বৈষম্য বিরোধী কোটায় মনোনীত জেলা পরিষদের সদস্য মিনহাজ মুরশীদের সাথে অশোভন আচরণ করায় কেন্দ্রীয় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন এক বিবৃতি দিয়ে জানায় রাঙামাটিতে বৈষম্য বিরোধ আন্দোলনের কোন কমিটি নেই।
রাঙামাটি জেলা বিএনপির সভাপতি দীপন তালুকদার ও সাধারণ সম্পাদক মামুনর রশীদ মামুন বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানে রাঙামাটিতে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন ছিল। বর্তমানে প্রশাসনও বিভিন্ন প্রোগ্রামে এদের দাওয়াতও দিচ্ছে। তবে তাদের মধ্যও বিভক্তি থাকায় সমস্যা হচ্ছে। ছাত্রদের বিভক্তি থাকায় এদের একটি অংশকে সুবিধাবাদী গোষ্ঠী ব্যবহার করবে সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। এদের বিভক্তির সুযোগ ফ্যাসিস্ট সরকারের সুবিধাভোগীরা আবার ফায়দা লুটবে। আমরা চাই না এ সরকারের মাঝে ফ্যাসিস্ট দোসর ঢুকে পড়ুক।