আমার প্রথম ও দ্বিতীয় বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে এতদিন আমি এডিসি হবার সকল শর্ত পুরণ করে ফেলতাম। জন্মের পর আমি যখন পরিবেশ বুঝতে শুরু করেছিলাম তখন সেনা পুলিশের অত্যাচার, ভূমি বেদখল, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেখেছি। অনেক ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আমি এক জীবন্ত ইতিহাস।
এত কিছু দেখেছি, এত কিছু হারিয়েছি, তাতে আমাকে হওয়ার কথা ছিল উগ্র সাম্প্রদায়িক। কিন্তু আমি মনে যতটা অসাম্প্রদায়িক চিন্তা লালন পালন করি ততটা করেন না যারা আমাদের সম্প্রীতির গল্প শোনায়। শান্তির গল্প শোনায়। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি মনোভাব চিন্তা চেতনা আমাকে পীড়া দেয়।
বাল্যকালে দেখেছি আমাদের গ্রামের সেনাবাহিনী আসত। তাদের সাথে থাকত খাকি পোষাকের পুলিশ। উভয়ই শান্তিবাহিনী খুঁজত। ভাল বাংলা জানা মানুষ তখন হাতেগোনা।
সেনাবাহিনীর কমন ডায়লগ ছিল এই সালার বেতা। কথার একটু এদিক সেদিক হলে জুটত বেতের আঘাত। পুলিশের ভূমিকা ছিল সেই সালার বেতাকে বেঁধে রশি টানাটানি করা।
এ ঘটনাগুলোর অবলোকনে চাকমাদের একটি প্রবাদ আছে। যেটি হল “থানা হুরেদি হানাও ন যায়”। অর্থাৎ থানার পাশে কানাও যায় না।
এখনকার পুলিশ আর সে পুলিশ নেই। সেই পুলিশ অনেক পরিবর্তন হয়েছে। বাঙালী পুলিশের সাথে পাহাড়ি পুলিশ দায়িত্ব পালন করে। পাহাড়িরা এখন পুলিশকে বাঙালী পুলিশ মনে করে না। আগে পাহাড়িরা পুলিশকে বাঙালী পুলিশ মনে করত। সে ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে পুলিশকে ভাই মনে করে। পুলিশও তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করেছে। পুলিশ কোন অপরাধের ঘটনায় জড়িতদের পাহাড়ি বাঙালী দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখে না।
গত ২০-৩০ বছরে পুলিশ যতটা পরিবর্তন হয়েছে তার বিপরীত সেনাবাহিনী। তাদের এখনো মৌলিক কোন পরিবর্তন আমার চোখে পড়ে না।
পাহাড়ে কোন সেনা ক্যাম্পে পাহাড়ি সেনাবাহিনী দেখা যায় না। অথচ শত পাহাড়ি সেনাবাহিনীতে কর্মরত আছে। পুরো ব্যাটলিয়ন যখন বদলী হয়ে পাহাড়ে আসে তখন পাহাড়ি সেনাবাহিনী সদস্যদের ফেলে আসা হয়। সেই ফেলে আসা সদস্যদের একজন আপনি হয়ে উপলব্ধী করুন। রাষ্ট্রের একজন সু নাগরিক হিসেবে আমি সেনাবাহিনীর নামকে শ্রদ্ধার চোখে দেখি।
আমি আমার এত বছর জীবনে এ বাহিনী কর্তৃক যতবার অপদস্ত হয়েছি ততবার অনুভব করি এরা কবে দৃষ্টিভঙ্গি চেঞ্জ করবে? কবে পলিসি চেঞ্জ করবে?
যুগ তো বদলে গেছে। কিন্তু যুগের সাথে তাল মেলাতে হলে দৃষ্টিভঙ্গী এবং পলিসি চেঞ্জ করা দরকার। আমি যেমন সেনাবাহিনী কর্তৃক হয়রানী প্রত্যাশা করিনা তেমনি কোথাও সেনাবাহিনী অপদস্ত হোক লজ্জিত হোক বা কোথাও হামলার শিকার হোক এটা প্রত্যাশা করি না। কিন্তু সেটি হচ্ছে। আজ কাউখালীতে সেটি হল। সকালে পাহাড়ের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কাউখালীর মাঝে আটকে ছিল। এটা খুবই দু:খজনক। বিকালে সংবাদ সম্মেলন গুরুত্ব সহকারে দেখেছি। উদ্ধার করা সরঞ্জাম মানলাম ইউপিডিএফের।
কিন্তু পোশাকে র্যাংক বেজ মেনে নিতে পারলাম না। আমি একদিকে সাংবাদিক অন্যদিকে পাহাড়ের সন্তান। পাহাড়ে আঞ্চলিক রাজনৈতিক বিশ্লেষকও বলতে পারেন আমাকে। কারণ আমি এ সম্পর্কে বিস্তর জানি।
ইউপিডিএফ সশস্ত্র সদস্যরা সেনাবাহিনীর পোষাক পড়ে ঠিক আছে কিন্তু এরা তো সে র্যাং ক লাগায় না। তো সে র্যাংক আসল কোথা থেকে? তো ডেবাছড়িতে ঐ পাহাড়ির ঘরে এ পোষাক ফেলে আসল কারা? এটা শুধু আমি কেন পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িরা বিশ্বাস করবে না।
পেশাগত কারণে বিভিন্ন সময় সামরিক অফিসারদের সাথে কথা বলার সুযোগ হয়। কিছুদিন আগে এক গুরুত্বপুর্ণ সেনা অফিসারের চায়ের নিমন্ত্রন পেয়েছিলাম। সেখানে অনেক অভিজ্ঞতা বিনিময় হল। পাহাড়কে কিভাবে সুন্দর করা যায় আমার কাছে কি থিউরী আছে সেটা জানতে চান। আমি কিছু পয়েন্ট বলেছি। সব ফুটবল নিজের হাতে রাখবেন না। কিছু ফুটবল ছেড়ে দেন। দায়িত্ব বন্টন করে দেন। অস্ত্র প্রদর্শন সীমিত করেন। এন্টিবায়টিকের অতিরিক্ত ব্যবহার করলে শরীরে আর কাজ করে না। ঠিক তেমনি অস্ত্রের প্রদর্শন বেশি করাতে পাহাড়ের মানুষ এখন আর অস্ত্র ভয় পায় না। তাই বলে সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে চলে যাক সেটা বলছি না। সেনা অবশ্যই পার্বত্য চট্টগ্রামে থাকবে। সেনাবাহিনী সর্বোচ্চ মর্যাদা নিয়ে থাকুক পাহাড়ে।
ছোটখাটো নিয়ে তাদের মাথা ঘামানোর দরকার নেই। কে কার সাথে প্রেম করবে, কে কাকে বিয়ে করবে এটা নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নেই। মাথা সেখানে ঘামাবে যেখানে মানুষ অবাক হবে। পাহাড়ি বাঙালী স্যালুট দিবে। অনুভব করবে সেনাবাহিনী আমার সর্বশেষ আশ্রয়।
বাঙালী ছাত্র পরিষদের সভাপতি হাবিব আযম জেলা পরিষদের মেম্বার হল। অথচ এরা চুক্তি নিয়ে কত বিরোধী কথা বলে। সদস্য পদ পেয়ে পার্বত্য বাঙালী সংগঠন সন্তুষ্টি অনুভব করে তাহলে চুক্তি বাস্তবায়ন করে দিই। দায়িত্ব দিয়ে তাদের কিছু ফুটবল দিই। যে ফুটবলগুলো সরকার তার হাতে রেখে দিয়েছে। চুক্তি বাস্তবায়নে মনযোগী হই। আরো কি করা গেলে পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায় স্টোক হোল্ডারদের সাথে বসেন।
একটি জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের জন্য কাজ করতে গেলে আগে দরকার সে জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস অর্জন করা। দেখা যাচ্ছে আমি তোমাদের মঙ্গলের জন্য কাজ করছি অথচ সেটি প্রমাণ করতে পরীক্ষা দিতে হচ্ছে বারবার। কিন্তু এ পরীক্ষা আমাকে দিতে হবে কেন?
তাই রাষ্ট্রের উচিত সময় এসেছে পাহাড়ের প্রকৃত শান্তি নিয়ে ভাববার। ক্ষুদ্র একটি অংশ চায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে। কিন্তু বৃহৎ অংশ চায় পাহাড়ে শান্তি ফিরুক চিরস্থায়ীভাবে। কারণ তাঁরা ওউন করে দেশটাও আমার। এ ভূমি আমার। এ ভূমি আমাকে রক্ষা করতে হবে। কিন্তু আমরা যুগে যুগে দেখছি পাহাড়ে মায়ের চেয়ে মাসীর দরদ বেশী দেখানো হয়। মাসীর দরদটি এমন পাহাড়িরা বুঝি তাদের জমি ভিটেমাটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে দিতে চায়?
কাউখালী, রাঙাপানি, সাজেক উজোবাজার, হুদুকছড়ি হাফ বাজার এসব অপ্রীতিকর ঘটনাগুলো কিন্তু আজকে শেষ নয়। আগামীতে আরো কত হবে বেঁচে থাকলে দেখতে পাব। মানুষ এখন আইন বুঝে। দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশের খবরও রাখছে। তাই অনুরোধ করব কাউখালীর দৃশ্য আমরা আগামীতে দেখতে চাই না।
পাহাড়ে সন্ত্রাস চাঁদাবাজি অপহরণ খুন পাহাড়ি কোন মানুষ পছন্দ করে না। এ থেকে এরা মুক্তি চায়। এ থেকে মুক্তি দিতে রাষ্ট্রের পলিসি কি হওয়া উচিত? এটা নিয়ে ভাববার সময়ে এসেছে। কারণ দেশটাও আমাদের। শুধু আমি কেন পাহাড়ের মানুষ সুন্দর পার্বত্য চট্টগ্রাম, সুন্দর বাংলাদেশ চায়।
লেখক: সাংবাদিক, রাঙামাটি।