রাত যতো গভীর হয়, ততোই উদ্বেগ আর উৎকন্ঠায় নির্ঘুম সময়ের সীমানা বাড়ে। বড়োই অবিশ্বাস আর সন্দেহে চেনা আপন-স্বজন কিংবা আত্মীয়কেও আর অকাতরে স্বাগত জানানো যায় না। নির্ভয়-স্বাধীন চলাফেরাও ক্রমশঃ সীমিত হয়ে আসছে।
এঘরে ইউপিডিএফ; ওঘরে জেএসএস। অথবা এ গ্রামে তাঁরা, ওই গ্রামে আমরা। এমনিই এক সময় পার করছে, পাহাড়ের মানুষগুলো।
বাংলাভাষী হিসেবে, এই সহিংস অংকের সমীকরণ আমাকে ভয়াবহভাবে না পোড়ালেও আমার পেশা, আমার সমাজ- স্বজন; এসবের সাথেই তো উঠাবসা চালাতে হয়। সুতরাং এড়িয়ে যেতে চাইলেও এড়ানো যায় না। মাথা থেকে ফেলে দিলেও ছাড় মেলে না।
বিগত প্রায় কয়েকটি দশক, এভাবেই রাত-দিন পার করছেন; তিন পার্বত্য জেলার বাসিন্দারা। এরমধ্যে বিশেষ করে চাকমা- মারমা- ত্রিপুরাসহ নানা জাতিসত্ত্বার মানুষরাই সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির শিকার।
শান্তির জন্য একটা সমঝোতামুলক চুক্তি হলো। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের পক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস)-র সভাপতি শ্রী জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু) লারমা’র সাথে সম্পাদিত এই চুক্তি বর্হিবিশ্বে “শান্তিচুক্তি” নামেই স্বীকৃতি পেলো। চুক্তির পর পাহাড়ে উন্নয়নের অজুহাতে ইউএনডিপিসহ বেশক’টি বড়ো-সড়ো দাতাসংস্থা সক্রিয় হয়ে উঠলো। গ্রামের পর গ্রাম সরকারের পাশাপাশি বেসরকারী উন্নয়নের আওতায় এলো। কর্মসংস্থান হলো বিশাল এক অংকের। ভোগ-বিলাসের সীমা ছড়িয়ে পড়লো, প্রত্যন্ত গ্রামেও।
পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে যাঁরাই নুন্যতম জ্ঞান রাখেন, তাঁরাই জানেন; এ অঞ্চলে বিদ্যমান রাজনৈতিক সমস্যার ইস্যুটি অনেক আগে থেকেই দেশের গন্ডি ছাপিয়ে বর্হিবিশ্বে প্রতিদিন প্রতিমুর্হুতে ভিন্নমাত্রা পাচ্ছে।
স্বাধীনতা উত্তর সময়ে বাংলাদেশে সবচেয়ে আলোচিত এবং গভীরতাসম্পন্ন সমস্যাও এখন, এটিই একমাত্র। ভাষা-জাতিগত-ভৌগলিক এবং সংস্কৃতিগত বৈচিত্র্যের কারণে পার্বত্যাঞ্চলের রাজনৈতিক ও পররাষ্ট্র সর্ম্পকিত গুরুত্বও ফেলে দেবার মতো নয়। সেই বৃটিশ আমল, উপমহাদেশ ভাঙ্গন এবং পাকিস্তান থেকে থেকে আজকের বাংলাদেশে এসেও সমস্যাটি যেনো, যেখানে ছিলো; সেখানেই স্থবির হয়ে আছে। কোন কোন ক্ষেত্রে সমস্যাটি নানামুখী ডালপালা ছড়িয়ে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের অভিযাত্রাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
তবে কী অনাগত দিনে আর কোনদিন, পার্বত্যাঞ্চলে বিদ্যমান সমস্যার সমাধান হবেনা? অথবা সমস্যাটি কী জিঁইয়ে-ই রাখা হবে, এমন অর্বাচীন প্রশ্নও তারার মতো জ্বলছে।
মোটাদাগে শান্তিচুক্তিকে এই অঞ্চলের সমস্যা সমাধানের পথে একটি বড়ো মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত করতেই হয়। অতীত উদাহরণের রেশ টেনে বলা চলে, চুক্তি’র ফলে এই জনপদের অধিকাংশ মানুষ বৈষয়িকভাবে উপকৃত হয়েছেন। রাজনৈতিকভাবে কতোটা হয়েছেন, তা এখনো অতোটা পষ্ট নয়।
এটাকে কোন তাত্ত্বিক আলোচনা হিসেবে ধরে না নেয়ার অনুরোধ জানিয়ে বলতে চাই, চুক্তি উত্তর পাহাড়ে নানামুখী সমস্যার জন্ম হয়েছে।
এই সমস্যাগুলোর মধ্যে ভূমি ব্যবস্থাপনার জটিলতা, ভূমি বিরোধ ও ভূমি বেদখল, জাতিগত বিদ্বেষ, আরোপিত সহিংসতা ও বিচারহীনতা, ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহারের প্রবণতা, অপরাধের রাজনৈতিকীকরণ- সাম্প্রদায়িকীকরণ এবং ভূমিহীন ও দরিদ্রের সংখ্যাবৃদ্ধি অন্যতম।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি ব্যবস্থাপনা বৃটিশ আমল থেকেই সামষ্টিক মালিকানা পদ্ধতির। যেখানে ব্যক্তির চেয়ে যৌথ এবং সামাজিক মালিকানা স্বত্বকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। এখানকার উৎপাদনপদ্ধতিও সেই ধাঁচের। আদিম সাম্যবাদের ধারণাপ্রসূত এই ব্যবস্থাপনা পৃথিবীর বহুদেশেই প্রচলিত আছে। এই যুগে যাঁরা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোর সৈনিক, তাঁরা হয়তো সম্পদ ও সম্পত্তির যৌথ মালিকানার ইস্যুটি আরো খোলাসা করতে পারবেন। তবে আমার মতে এটা একটি ঐশ্বরিক ব্যবস্থা। পৃথিবীর শুরুতে সৃষ্টিকর্তা কাউকেই ধনী বা গরীব কিংবা ভূমিপতি বা ভূমিহীন হিসেবে সৃষ্টি করেননি। কিন্তু কালক্রমে পৃথিবীর দেশে দেশে জোরজবরদস্তির মধ্য দিয়ে পূঁজিবাদের বিকাশ ঘটেছে। আর সে পূঁজিবাদের হাত ধরে ব্যক্তি বিশেষ ভূমিপতি হয়ে উঠা এবং অধিকাংশ মানুষ ভূমিহীন হয়ে পড়েছেন।
তথ্য-তালাশ করলে পার্বত্য চট্টগ্রামেও এমনটি ঘটেছে বলে প্রমাণ পাওয়া যাবে। আর এই একটিমাত্র কারণেই পার্বত্যাঞ্চলে দীর্ঘদিন আইন-আদালতের খুব বেশী প্রয়োজন পড়েনি।
কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় উপ-মহাদেশ, দেশ ভাগ হলো। পরিবর্তন ঘটলো রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং রাজনীতির। আর এই রাজনীতির ছন্দ-পতন ছুঁয়ে গেছে, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাংশের এই উপত্যকাকেও। বিশেষ করে পাকিস্তান সরকার ৬০’র দশকে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য বড়ো অংকের ভূমি অধিগ্রহণের মধ্য দিয়ে এই অঞ্চলে ভূমিগত জটিলতার আগুন সৃষ্টি করেন।
স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই একাধিক ভূমি ব্যবস্থাপনা অনুসরণের প্রক্রিয়া চালু হয়ে যায় পার্বত্য এলাকায়।
ভূ-রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, সমতলের দূর্যোগ কবলিত মানুষের ভূমিহীনতা এবং রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব সুনিশ্চিত করার অভিপ্রায়ে আশির দশক থেকে সরকার বসবাসযোগ্য ভূমির ব্যবহারে মনোযোগী হয়ে উঠে। একইসাথে দ্রুত সহিংস হয়ে উঠতে থাকে পার্বত্যাঞ্চলের গহীন অরণ্যের শান্ত জনপথও। আর এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় তখনকার সরকার প্রয়োজনে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার পথে এগিয়ে যাবার আর কোন বিকল্প খুঁজে পায়নি। অনিবার্য্য এক সংঘাতের পথ ধরে পাল্টে যায়, পাহাড়ের সব ব্যবস্থাই। সেই এলোমেলো অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন ঘটেনি শান্তিচুক্তি’র পরের দুই যুগেও।
কাপ্তাই বাঁধজনিত অধিগ্রহণ এলাকা বাদ দিলে পার্বত্য চট্টগ্রামে আরো অনেক ভূমি রাষ্ট্রের মালিকানায় ছিলো। তবে এসব ভূমির বিশাল একটি অংশ সংরক্ষিত বনের আওতায় হবার কারণে স্থানীয় এবং পূর্নবাসিতদের মধ্যে ভূমি নিয়ে একধরনের সহিংস মনোজাগতিক যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি হয়। এটা কতোটা ভয়াবহ এবং বীভৎস তা প্রত্যক্ষদর্শী এবং ভুক্তভোগী ছাড়া অন্যদের পক্ষে স্বপ্নেও কল্পনা করা কঠিন। এককথায় শুধুমাত্র ভূমি’র কারণেই পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকাংশ এলাকা তাজা প্রাণের রক্তে সিক্ত হয়ে আছে।
দেশ স্বাধীনের পরে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ, যোগাযোগ সম্প্রসারণ, অবকাঠামো-আবাসন নির্মাণ, পর্যটন, নিরাপত্তাবলয়, গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন, রাবারবাগান, ব্যক্তিগত মালিকানা এবং ধর্মীয় স্থাপনা বৃদ্ধির কারণে পাহাড়ের অধিকাংশ সমতল ভূমি থেকে সাধারণ মানুষের অবাধ অধিকার সংকুচিত হয়ে পড়ে। সবচেয়ে আশংকাজনক হারে বাড়তে থাকে ব্যক্তি বিশেষের ভূমিপতি হয়ে উঠা। বন্দোবস্তি-লীজ’র নামে রাষ্ট্রের ক্ষমতাবান মানুষরা চর দখলের মতো করে তিন পার্বত্য জেলায় মাইলের পর মাইল দখল করে আছেন। রাজনৈতিক অণুকম্পায় চর দখলের সেই প্রবণতা পার্বত্যচুক্তির পর কিছুটা কমলেও এখন চলছে কর্পোরেট কোম্পানীর আগ্রাসন। যদি নাম ধরে বলতে হয়, তাহলে ছোট-খাটো একটি বালাম বানানো যাবে পাহাড়ের ভূমিখেকো সেসব প্রতিষ্ঠানের তালিকা দিয়ে।
খুব আশ্চর্য্যরে বিষয়, তিন পার্বত্য জেলার দরিদ্র পাহাড়ি-বাঙালি উভয় জনগোষ্ঠি-ই; এই অমানবিক বাণিজ্যিক আগ্রাসনের শিকার হচ্ছে। কখনো-কখনো পরিকল্পিত ভূমি আগ্রাসন চালানোর সুবিধার্থে এসব চিহ্নিত কর্পোরেট কোম্পানী, শিল্পগ্রুপ এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান সাধারণ মানুষকে জাতিগত দাঙ্গায় জড়িয়ে দেয়। তাঁর বড়ো প্রমাণ বিগত ২০১১ সালের ১৭ এপ্রিল রামগড়ে সংঘটিত প্রাণঘাতি ভূমি বিরোধ।
কেউ স্বীকার করুক আর নাই করুক, পার্বত্য চট্টগ্রামে ভয়াবহ মাত্রায় জাতিগত বিদ্বেষ টিকে আছে। শুধু টিকে আছে বললেও ভুল হবে। শিক্ষা-তথ্যপ্রযুক্তি উৎকর্ষতার এই যুগে সাম্প্রদায়িকতা যেনো, পাহাড়ে উপরে উঠার বিশাল এক সিঁড়ি হয়ে আাছে। প্রত্যেকটি জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনের আগে এবং কোন কোন সময় কোন উৎসবকে টার্গেট করে এই জনপদে সস্তা সাম্প্রদায়িকতা যেনো উদগ্র হয়ে উঠে। দরিদ্র পাহাড়ি-বাঙালির মাথা বিক্রি করে, রাজনীতিকদের একটি চিহ্নিত অংশ।
যুগের পর যুগ এমন অবস্থা বিরাজ করলেও রাষ্ট্র বা সরকার জাতিগত বিদ্বেষ প্রশমন এবং মানুষে মানুষে চিন্তা ও মনন উন্নয়নে কোন পদক্ষেপ নেয়নি। ফলে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম সঞ্চারিত হচ্ছে, জাতিগত বিবেচনায় একে-অপরের প্রতি অপ্রকাশিত মাত্রার এক জঘন্য ঘৃণাবোধ। বিশেষ করে সরকারী-বেসরকারী মিডিয়ায় দৃশ্যমান সমস্যাকে প্রাধান্য দেয়া হলেও অদৃশ্যমানতার কারণে হিংসার ডাইনোসরটি একেবারে ধামাচাপা পড়ে আছে। বুদ্ধিবৃত্তিক উপায়ে এর সমাধান করা গেলে হয়তো ভবিষ্যত প্রজন্ম নিজেদের একই রাষ্ট্রের সম-মর্যাদার নাগরিক হিসেবে সমৃদ্ধ সহাবস্থানের পথও খুঁজে নিতে পারতো।
নির্ঘুম সময়ের বৈরী অবৈরী ভাবনা
RELATED ARTICLES